মূল্য মাঝে জীবনবোধ

মূল্য মাঝে জীবনবোধ
-রীণা চ্যাটার্জী

“নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে মুখ তুলিয়া বলিল, আল্লা! আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেচে। তরে চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখে নি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয় নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ ক’রো না।” (“মহেশ”- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
খুব মনে পড়ছে এই কথাগুলো বেশ কয়েক দিন ধরেই। নাহ্ ‘গফুরে’র প্রার্থনা ওপরে কোনো ভাবেই পৌঁছায় নি তা বলাবাহুল্য।
কিছুদিন আগে সফরকালে দেখলাম বেশ কিছু জরা জীর্ণ গবাদিপশু। হাড় জিরজিরে পাঁজর গোনা যায় এমন অবস্থায় রুক্ষ জমিতে ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারা চোখে পড়েছে ঠিকই কিন্তু দূর থেকে চোখ দেখতে পাইনি, তাই চোখে জলের ধারা ছিল কি? না, ঠিক বলতে পারলাম না। তবে চেতনা বলে গেল, ‘মহেশ’রা কাঁদে- কান্নার সাক্ষ্য দেয় ওদের পাঁজর গোনা চেহারা। ‘মহেশ’-দের মালিকের নাম গফুর, কাশিম নাকি হরিপদ বা কালিপদ জানা নেই- কিন্তু ‘মহেশ’রা মালিকের জাত চেনে না, স্পর্শ বোঝে। আর ওদের মালিকরা অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, জোতদার, জমিদার সবার থেকে ওদের সন্তান স্নেহে আগলে রাখার আপ্রাণ অসম যুদ্ধ চালিয়ে যায় সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। জাত, ধর্ম, বর্ণ সবকিছু তুচ্ছ ওদের এই আত্মিক টানের কাছে। তর্করত্নরা অহঙ্কারী জ্ঞানের ঝুলি নিয়ে এগিয়ে আসে, নির্লজ্জ স্বরূপ উন্মোচিত হলেও লজ্জিত হয় না কখনো। এরা ধর্মের কাণ্ডারি! আর মানবতা?
জমিদার থেকে পেয়াদা ক্ষমতার আষ্ফালন দেখায় নিরীহ অর্ধভুক্ত, অভুক্ত ‘গফুর- মহেশ’ এর উপর। উন্নাসিক দাম্ভিকতায় এরা ন্যায়ের কাণ্ডারি! আর মানবতা?
না- ওই পাঠশালা তো এদের জন্য নয়। তবে যুগ যুগ ধরে ‘তর্করত্ন- জমিদার- পেয়াদা’ আছে, থাকবে। শুধু খানিকটা রূপের হেরফের হয়েছে, হবে।
‘মহেশ’ রক্ত অশ্রু নিয়ে মরবে সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। আর গফুর? ওরা তো হারিয়েই যায়। আমিনা? ওদের গল্প তো নতুন কিছু নয়। শহুরে বাবুরা আবার তর্কে মাতবেন- ‘মেয়েরা এখন অনেক স্বাধীন’, ‘মেয়েরা এখন অনেক ভালো আছে’, ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’। আর গ্ৰামীণ মাতব্বরেরা বলবেন- ‘মেয়েমানুষের (!) আবার কিসের কথা?’ ইত্যাদি… প্রভৃতি…তাই অব্যক্ত থাক আমিনার প্রসঙ্গ।
‘গফুর’দের সামান্য দাবী সমাজ স্পর্ধা মনে করে। ওরা খেতে পেলো কি না! বা জীবনের নূন্যতম প্রয়োজন- টুকুও মিটলো কি না কারোর দেখার সময় নেই। কিন্তু ওদের ন্যায়-অন্যায়ের বিচারের জন্য সমাজপতিরা সদাজাগ্রত। ওদের ঘরের আব্রু থেকে সম্মান সব আত্মসাৎ করার জন্যও সমাজপতিদের ব্যগ্ৰতার নির্লজ্জতা চোখে পড়ার মতো। তবে সমাজপতিদের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। এরা তো মূল্যবোধ জলাঞ্জলী দিয়ে তৈরী করা জীবন বোধে বাঁচে।
‘গফুর’ রা কিছুদিন বাঁচে, বাঁচার চেষ্টা করে সব অন্যায় মেনে নিয়ে। সমাজের আরোপিত সব মূল্য নিঃশর্তে চোকাবার দায় নিয়ে, মূল্য মেটাবার মূল্যবোধ যে ওদের জীবন বোধ!
তারপর সবশেষে একদিন হারিয়ে যায়।
বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ‘মহেশ’ গল্পের সুস্পষ্ট উদাহরণ মনে হয়। সমাজপতিরা সুযোগ আর স্বার্থের খেলায় ‘মঞ্চ’ ব্যবহার করে জ্বালাময়ী বক্তব্য রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। তার জেরে ‘মহেশ, গফুর, আমিনা’- মরছে, হারাচ্ছে, মানিয়ে নিচ্ছে।

ফিরে আসি মন ছোঁয়া কিছু কলমের কথায় – ‘হাজারো স্বপ্নের শব’, ‘দৃষ্টি’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘ভূতের ভাবনা’, ‘আমার আমি কই’, ‘মৃত্যুর মাঝে’, ‘কে সেই মেয়েটি’, ‘উত্তীর্ণ’, ‘তোর জন্য’, ‘শাস্তি’, ‘ভীষ্ম সংবাদ’, ‘বাঙলার দূর্গা’।
অতিবৃষ্টি- অনাবৃষ্টি মৌসুমী বায়ুর খামখেয়ালী আচরণ নিয়ে চলছে এই বছরের ‘বর্ষা-পালা’।
খামখেয়ালী মৌসুমী বায়ুর হাত ধরেই সকলের জন্য বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ শুভেচ্ছা, শুভকামনা, ভালোবাসা রইলো আলাপী মনের পক্ষ থেকে। চিরন্তন হোক কলমের পথচলা।

Loading

Leave A Comment